সত্য ঘটনা অবলম্বনে

ডাক্তারি পেশার সাথে যুক্ত আমি বেশ অনেক বছর ধরেই। পুরোটাই বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা ধারার মানুষিকতার লোক আমি। কিন্তু তা হলেও এখনও পর্যন্ত ভূত না দেখলেও কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষি আমি হয়েছি। দিন কয়েক আগে আমার এক উকিল বন্ধুর সাথে কথায় কথায় ভূত আছে না নেই সেই প্রসঙ্গে কথা ওঠার সময় আমার বন্ধুটি তার নিজের সাথে ঘটা এক অদ্ভুত ঘটনার কথা আমায় জানায়। তার মুখ থেকে বলা কথা গুলো আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিখলাম।

“বিগত পাঁচ বছর ধরে আমি ওকালতি প্র্যাকটিস করছি। বারাসাত কোর্টে আপাতত আমি কর্মরত এটা তো তুমি জানোই। তাই বাড়ি থেকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য আমি একটা বাইক কিনেছি দু বছর আগে। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখি, আমি ভূত বা ভৌতিক ব্যাপারে তেমন একটা বিশ্বাস করিনা আবার অবিশ্বাসও নেই, কারন ভূত না মানলেও ভগবানে আমার অঢেল বিশ্বাস। তবে তাদের অস্তিত্ব আমি স্বীকার করি। কিন্তু একটা ঘটনা আমার সাথে গত বছর ঘটেছে যার যথার্থ কোন ব্যাখ্যা এখনও অবধি আমি নিজেই নিজেকে দিতে পারিনি।

বারাসাত কোর্টে যাওয়ার পথে বাইকে প্রায় মিনিট দশেকের একটা রাস্তা পড়ে। রাস্তার দুপাশে যতদুর প্রায় চোখ যায় ততটাই বিস্তীর্ণ ক্ষেত জমি। সেই ক্ষেত জমির বেশ দুরে ছড়ান ছেটানো ভাবে দু একটা ছোট ছোট মাটির ঘর চোখে পরে। ঘটনাটা ঘটে গত বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। সারাদিন কাজের ভেতরে থাকতে হয় তাই ঠাণ্ডা আমার মালুম হয়না তবে একটু সন্ধ্যের দিকে এই ক্ষেত জমির ফাঁকা রাস্তায় একটু ঠাণ্ডা অনুভব হয়, তবে সেটা বেশ উপভোগ্য। রাস্তা থেকেই দেখা যায় ক্ষেত থেকে ধান কেটে নেওয়ার পরে ধানের আঁটিগুলো ক্ষেতের মাঝে একসাথে জড়ো করে রাখা হয়েছে মাঝে মাঝে। ওইটুকু সময়ে বাইক চালাতে চালাতে মেজাজটাও খুব ফুরফুরে হয়ে যায় আমার। সেইদিন কোর্টের কাজ সারতে একটু বেশি বেলা হয়ে গেলো। শীতকালের বেলা। দেখতে দেখতেই যেন ফুরিয়ে যায় হুস করে। কোর্ট থেকে যখন রওনা দিলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বেশ জোরেই বাইক চালিয়ে আমি যখন ক্ষেতের রাস্তায় এসে পড়েছি তখন হটাৎ খেয়াল করলাম বাইকটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। মনে হল হ্যান্ডেলটা যেন নিজের খেয়ালেই সোজা চলেছে, ডানদিক বাঁ দিকে ব্যাঁকানো যাচ্ছে না, শুধু তাই নয় সেটার গতিও যেন আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা বুঝতে পারার সাথে সাথেই বাইকে বসেই আমার গা কেমন ভারী হয়ে উঠলো। সামনে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম কোথা থেকে একরাশ ধোঁয়াশায় সামনের দিকের দৃশ্য প্রায় ঝাপসা হয়ে গেছে। সাঁ সাঁ আওয়াজে বুঝতে পারছি বড় বড় পাঞ্জাব লরি, ট্রাক প্রচণ্ড গতিতেই আমায় ওভারটেক করে পাশ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এটা বোঝার সাথে সাথেই আমার মনে এবার একটা অজানা ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এই অবস্থায় যদি একটা লরির সাথে আমার বাইকের সামান্য ঠোকা লাগে তাহলেই আমার মৃত্যু নিশ্চিত। বডিটাও হয়তা আর পাওয়া যাবেনা। একবার পাশে তাকিয়ে বুঝলাম তখনও সেই ক্ষেত জমির রাস্তা আমি অতিক্রম করতে পারিনি। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত লাগলো আমার! এতোটা জোরে বাইক চালানোর পরেও এই দশ মিনিটের রাস্তা পেরোতে না পারার কারন আমি সেই সময় বুঝতে পারলাম না। তখন আমার মস্তিষ্ক ভেতর থেকে বার বার জানান দিচ্ছে, যে ভাবেই হোক এখুনি বাইকটাকে থামানো দরকার। নাহলে আমার আজ একটা দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। আমার পাশ কেটে বেরিয়ে যাওয়া লরি ট্রাকের গম্ভীর সব আওয়াজ কে ছাপিয়েও যেন আমার নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ আমার কানে ধাক্কা দিতে লাগলো, মাথার হেলমেটটাও যেন সেই আওয়াজের সাথে আরও জোরে আমার মাথায় চেপে বসেছে তখন, সময়ের হিসেব নেই আমার কাছে, এক একটা সেকেন্ড যেন একটা ঘণ্টা মনে হচ্ছে আমার কাছে। এর মধ্যেই যেন নিজে থেকেই ধীরে ধীরে গতি কমে এলো বাইকের, রাস্তার একপাশে কোনরকমে দাঁড় করালাম আমি বাইকটাকে। কিন্তু বাইক থেকে নামার সাথে সাথেই কেন জানিনা আমার গোটা শরীরে একসাথে কাঁপুনি উঠলো। রাস্তার ধারেই বসে পড়লাম আমি। বসার অল্পক্ষণের মধ্যে কাঁপুনি থামল বটে কিন্তু সাথে সাথে যেন ঠাণ্ডায় আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেলো, অথচ এতটা পথ বাইক চালিয়ে এলাম কিন্তু ঠাণ্ডার তেমন কোন আভাস পাইনি। এখন যেন কোথা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাঁপটা এসে আমার চামড়া ভেদ করে সরাসরি হাড়ের ভিতরে গিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো ক্রমাগত। কাঁপতে কাঁপতে আমি এবারে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। হটাৎ করে এতোটা কাবু হয়ে গেছি যে, মাটি থেকে কিছুতেই উঠে বসতে পারছিনা। মাথার ভেতরটা যেন পুরোটাই ফাঁকা হয়েগেছে এই পরিস্থিতে।

বোকার মতো রাস্তার একপাশে শুয়ে কিভাবে নিজেকে বাঁচাবো এই চিন্তা করছি এমন সময় আমার সামনে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে একটা দশ চাকার লরি বিকট হর্ন বাজিয়ে ছুটে গেলো সামনের দিকে, ঠিক তার পরমুহুর্তেই একটা বিকট আওয়াজ পেলাম, যেন সামনেই কোথাও একটা বিস্ফোরণের শব্দ আমার কানে এসে ঢুকল। আর ম্যাজিকের মতোই সেই শব্দের সাথে আমার শরীরের অস্বস্তি ভাবটা অনেকটা কমে গেলো। গায়ে হাতে একটু জোর পেলাম এতক্ষনে। শীতটাও যেন আচমকাই অনেকটা কমে গেছে অনুভব করলাম। মাথার চাপ ভাবটাও আর নেই বললেই চলে। তাই কোনোরকমে এবারে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম আমার থেকে বেশ কিছু দুরে একটা সাদা গাড়ির সাথে মুখোমুখি একটা লরির ধাক্কা লেগেছে। সাদা গাড়িটার কিছুটা রাস্তা থেকে ক্ষেতের দিকে কাত হয়ে পরে আছে, সামনের দিকটা প্রায় কাগজের ঠোঙার মতো চুপসে গেছে, আর সেখান থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে সেইদিকেই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে গেলাম। লরির বা পাশের খোলা দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি ড্রাইভারের শরীরের কিছুটা অংশ সামনের কাঁচ ভেঙে বাইরে ঝুলছে। আরও কিছুটা কাছে আসতেই টায়ারের পোড়া গন্ধ আমার নাকে এলো, নাকে হাত চেপে এবারে আরও একটু এগিয়ে গেলাম সাদা গাড়িটার দিকে। সামনের দিকে দরজা বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, লরির ধাক্কায় সবটাই তাল পাকিয়ে প্রায় চেপ্টে গেছে, আর পেছনের দিকের বা পাশের দরজাটা খোলা, সেখানে এবার উঁকি দিতেই দেখলাম একটা রক্তাক্ত হাত বাইরে বেরিয়ে আছে, এখনও সেই হাত থেকে রক্তের ধারা ধীর গতিতে বেরিয়ে চলছে। ভেতরের মানুষটা বেঁচে আছে কিনা সেটা দেখার জন্য আরও একটু ঝুঁকতেই দেখলাম একটা রক্তাক্ত শরীর, শুধু রক্তাক্তই নয়, ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত ডান পাশ প্রায় থেঁতলে যাওয়া একটা শরীর। মাথার একপাস থেকে রক্তমাখা ঘিলু বেরিয়ে এসেছে। সেই পাশের চামড়া বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, চোখের মনিটাও যেন অনেকটাই বাইরে বেরিয়ে ঝুলছে।

এই দৃশ্য আমি আর দেখতে পারলাম না, লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটার চিন্তা না করেই আমার বাইকের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। এতোটা সময় ধরে মাথায় যে পরিমান চাপ সৃষ্টি হয়েছে আর তার সাথে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা আমি আর নিতে পারলাম না, অচৈতন্য হয়ে গেলাম সেখানেই।

চোখ খুলে যখন তাকালাম তখন আমার মুখের সামনে বেশ কিছু মুখ দেখতে পেলাম, তারপর একটু ধাতস্থ হতে বুঝতে পারলাম আমি একটা দোকানের বেঞ্চে শুয়ে আছি, আমায় ঘিরে বেশ কিছু লোকের জটলা তৈরি হয়েছে সেখানে। সেই লোকের ভেতর থেকে একটা কালো কোঁকড়ানো চুলের রোগা করে লোক জিজ্ঞেস করলো- “কি দাদা? কি হয়েছে? ওভাবে রাস্তার ধারে পরে ছিলেন কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”

-একটু ঘাড় নাড়িয়ে আমি উত্তর দিলাম, একটু আগে এখানে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সেটা দেখতে গিয়েই আমার মাথাটা ঘুরে গেলো। আমার বাইকটা কোথায় কেউ দেখেছেন?

রোগা লোকটার মুখটা একটু যেন কুঁচকে গেলো। তারপর কি ভেবে কৌতুক মাখানো গলায় বলল- “দাদা কি নেশা করেছেন নাকি? কিন্তু কোন গন্ধ তো পাচ্ছিনা মুখ থেকে। বাড়ি কোথায় আপনার? কোন অ্যাকসিডেন্টের কথা বলছেন আপনি?”

আমি ভীষণ অবাক ভাবে বললাম- আমার নাম সুধিন তাকুলদার, বাড়ি আমার খড়দা তে। ওকালতি করি। কিন্তু একটু আগে যে দেখলাম আমি? একটা লরির সাথে একটা সাদা গাড়ির কি ভীষণ জোরে ধাক্কা লাগলো, বিকট একটা শব্দ পেলাম, নাকে টায়ারের পোড়া গন্ধ এখনও পুরোটা যায়নি আমার, রক্তাক্ত হাত, ওই বীভৎস থেঁতলানো মুখের একপাশ। এতোটা স্বপ্ন হবে নাকি? আর আমার বাইকটা কোথায়?

এবারে বেশ বিরক্ত ভাবেই লোকটা বলল- রাস্তার ধারের এই ছোট চা এর দোকানটা আমার। বিগত পাঁচ বছর ধরে আমি এখানে ব্যাবসা করছি, ওই সামনেই আমার বাড়ি। এই পাঁচ বছরে এখানে কোন অ্যাকসিডেন্ট হয়নি দাদা। আমি আজ দোকান খুলতে এসে দেখি একটু দুরে রাস্তার পাশে আপনি অজ্ঞান হয়ে পরে আছেন আর আপনার বাইকটার সামনেটা একেবারে গেছে, ওই যে দেখুন দোকানের ওই পেছনে রাখা আছে। আমি আপনার অবস্থা দেখে পুলিশে খবর দিয়েছি, ওরা এসে পড়লে আপনি ওদের সাথে বাড়ি চলে যাবেন।

বেশ কিছু সময় পরে পুলিশের গাড়িতে তিনজন পুলিশ এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, ওদের প্রশ্নের উত্তরে আমি আবারও সেই একই ঘটনা বললাম ওদের কিন্তু ওদের মুখের ভাব দেখেই স্পষ্ট বোঝাই যায় একজনও সেটা বিশ্বাস করেনি, নেহাত আমি পেশায় উকিল তাই ব্যাপারটা আর বেশিদূর এগোয়নি। ওদের জিপে করে বাড়ি এলাম, বাইকটা ঠিক করে হাতে পেলাম আরও দিন দশেক পরে। তার পরেও সেই ঘটনাটার জন্য আমি সেই রাস্তায় আরও কয়েকমাস যাতায়াত বন্ধ রেখেছিলাম। তারপরে বহুবার সেই রাস্তায় যাতায়াত করেছি কিন্তু সেইদিনের মতো ঘটনার আর ঘটেনি আমার সাথে”।

এতোটা শুনে আমি এবারে বিরক্ত হয়ে গেলাম। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললাম- “আমাদের বিষয়টা ছিল ভূত নিয়ে, কিন্তু তোমার গল্পে ভূত কোথায়?”

বন্ধু একটু জল খেয়ে বলল- “আমার ঘটনাটা এখনও শেষ হয়নি। আরও একটু আছে। বাকিটা শুনে নাও আগে। সেদিনের ঘটনাটা আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে। গত মাসে আমি কোর্ট থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় খুব তেষ্টা পেল। সাথে জলের বোতলটাও ভরা নেই তাই বাধ্য হয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। দোকানটা সেই ফাঁকা ক্ষেত-জমির রাস্তাতেই পরে। দোকানের বেঞ্চে বসে একটা চায়ের কথা বলে পাশের জলের জগ থেকে জল খেলাম। প্রান ভরল আমার এতক্ষনে। এবারে চা এর কাপ হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়েছি তখন কানে এলো পাশ থেকে দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে- “কাল রাতে অ্যাকসিডেন্টটার সময় তুই ছিলি?

-না রে। আমি তো হরিদার থেকে শুনলাম। ঠিক কি হয়েছিলো রে?

-আরে আমার দাদা লোকটাকে প্রথম দেখে, রাস্তার ধারে বাইক নিয়ে পরেছিল। মাথার এক পাশ থেঁতলে গেছে, চোখের মণিটা কিছুটা বাইরে বেরিরে এসেছে, মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যা তা অবস্থা। দাদা লোকটার কাছে যেতে তখনও বোধহয় একটু প্রান ছিল। দাদাকে দেখে লোকটা কোনোরকমে কয়েকটা কথাই নাকি বলতে পেরেছে। হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগটুকু আর দেয়নি।

-কি নাম বলল রে?

-দাদা বলল লোকটার নাম সুধিন তালুকদার, বাড়ি খড়দা, পেশায় ওকালতি।

ওইটুকু শোনার পর থেকেই আমার মাথায় আবার সব কিছু কেমন যেন গোল পাকিয়ে গেলো। আমি সেখান থেকে কোনরকমে বাইকে উঠে রওনা দিয়েছি। এবারে তুমি বল ভাই, এটাকে কি ভাবে ব্যাখ্যা করবো আমি?”

এটা শোনার পরে আমিও বেশ কিছু সময় সেখানে চুপ করে বসেছিলাম। সত্যি বলতে আমার কাছেও এই ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

(প্রসঙ্গত এই ঘটনাটি যার সাথে ঘটেছে তার নাম আমি পরিবর্তন করেছি, কারন আমার বন্ধুটি নিজের নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নয়)


(সমাপ্ত)

#কলমেঃ কালো ঘোড়া

Post a Comment

Previous Post Next Post